মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে হিমাগারগুলোতে আসতে শুরু করেছে প্রচুর পরিমাণ আলু। তবে ভাড়া নির্দিষ্ট করা হয়নি আলু সংরক্ষণের জন্য সচল ৬৪টি হিমাগারে। তবে এই সমস্ত আলু অধিকাংশই আসছে উত্তরবঙ্গ থেকে। এখনো মুন্সীগঞ্জে পুরোপুরি আলু উত্তোলন শুরু হয়নি। তাই মুন্সীগঞ্জের পাইকাররা উত্তরবঙ্গের রাজশাহী দিনাজপুর, নাটোর, রংপুর থেকে আলু কিনে এনে হিমাগারে সংরক্ষণ করছেন।

মুন্সীগঞ্জের প্রধান ফসল আলু। প্রতিবছর এ জেলায় প্রচুর আলুর আবাদ হয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে দাম কিছুটা কম থাকায় প্রতি বছর এখানে উৎপাদিত বিপুল আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেন কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি অন্য জেলা হতেও আলু এনে এ জেলার হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। পরে যখন চাহিদা-দাম বাড়ে তখন হিমাগারগুলো থেকে সরবরাহ করেন কৃষক, ব্যবসায়ীরা। আলু উৎপাদনের তুলনায় কৃষকের সংরক্ষণের জায়গা স্বল্পতার কারণে ফি বছর হিমাগারে আলু রাখতে কৃষকরা ভিড় করেন।

এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিবছরই মালিকেরা হিমাগারে আলু রাখার ভাড়া বাড়িয়ে দেন। তবে এ বছর মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে ভাড়া বাড়বে না বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

জেলা সদরের সিদ্ধেশ্বরী নামের হিমাগারের মোশাররফ হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, এখনো মুন্সীগঞ্জের আলু উত্তোলন শুরু হয়নি। তাই রাজশাহী, দিনাজপুর থেকে আলু কিনে এনে মুন্সীগঞ্জের হিমাগারে রাখছি। এ বছর ওই অঞ্চলের জমিতে ১৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। কোল্ডস্টোর ভাড়াসহ ২০ থেকে ২১ টাকা প্রতি কেজি আলু পড়বে। গত বছর দাম কম হওয়ায় লোকসান হয়েছে।

অপর ব্যবসায়ী রিপন বলেন, ‘গতবছর লোকসান হয়েছে। এবার আবার আলু কিনা রাখতেছি। প্রতি কেজি আলু এখন রাজশাহী, দিনাজপুর থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে কিনে আনছি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খুরশিদ আলম বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। এবছর এখন পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে ২৫ মেট্রিক টন করে আলু পাওয়া গেছে। সে হিসেবে চলতি বছর ৮ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হতে পারে।

‘আর জেলায় আলু সংরক্ষণের জন্য সচল রয়েছে ৬৪টি হিমাগার। এসব হিমাগারের সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণের বাইরে থাকে।’

ইউনুস কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডের ক্যাশিয়ার মো. রাজিব হোসেন বলেন, আমাদের ভাড়া এ বছর এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে মনে হয় না এবার ভাড়া বাড়ানো হবে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোসারফ হোসেন পুস্তি বলেন- বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, জেনারেটর চার্জ, হিমাগার লোড-আনলোড খরচ, লেবার খরচ ও আনুষঙ্গিক খরচসহ হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের ন্যূনতম ৪ টাকা ৮০ পয়সা ব্যয় হয়।

গত বছর হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য কেজি প্রতি ৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল। এবছর খরচ বেশি হওয়ায় আরো ২৫ পয়সা বেশি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এর কম হলে লোকসান ছাড়া উপায় থাকবে না। মুন্সীগঞ্জে হিমাগারের সংখ্যা বেশি। সেখানে হিমাগারে আলু ঢোকানো নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। তাই অন্য জেলার তুলনায় ভাড়াও কম।

সদরের দেওয়ান কোল্ড স্টোরেজের মালিক আরশ দেওয়ান বলেন, তার হিমাগারে সাত লাখ বস্তা আলু রাখা হয়। গত বছর ৫০ কেজির বস্তা ২০০ টাকা করে ভাড়ায় রাখা হয়েছিল। এবারও এ ভাড়ায় রাখা হবে।

মাল্টিপারপাস হিমাগারের মালিক গোলাম মস্তাফা বলেন, গত বছর ৫২-৫৫ কেজির বস্তা হিমাগারে রাখতে ২৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। চলতি মৌসুমে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। রিভারভিউ কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম বলেন, আমাদের হিমাগারে ১ লাখ ৭০ হাজার বস্তা আলু রাখা হয়। শুনেছি বিদ্যুৎ বিল আগের চেয়ে বাড়ানো হবে। সেটার উপর ভিত্তি করে হয়তো ভাড়া নির্ধারণ হবে। আগের চেয়ে বাড়বে কিনা সেটা এখনো নিশ্চিত না।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার যোগনীঘাট এলাকার আলুচাষি সাইফুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই গত মৌসুমে আলুতে অনেক বড় লোকসান হয়েছে। আলুর দাম কম, অন্যান্য খরচ বেশি। ৫০ কেজির বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে ২০০ টাকার বেশি নেওয়া হলে সেটা আমাদের জন্য জুলুম হবে।

আলুতে লোকসান কমিয়ে আনার বিষয়ে কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোসারফ হোসেন পুস্তি আরো বলেন, ১০-১৫ বছর আগে মুন্সীগঞ্জ জেলায় ব্যাপক আলুর উৎপাদন হতো। সে হিসেবে মুন্সীগঞ্জে অসংখ্য হিমাগার গড়ে ওঠে। তবে এখন দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে আলুর ব্যাপকভাবে আবাদ শুরু হয়েছে।

এর ফলে দেশে আলু উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। আলু সংরক্ষণের পরেও অনেক আলু থেকে যাচ্ছে। এতে আলুর দাম কমে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছরই কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকারের উচিত আলুকে শিল্পে রূপ দেওয়া। আলু ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। ভাতের বিকল্প হিসেবে আলুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা। সব শেষে যে বছর আলুর উৎপাদন বেশি হবে, তখন ভর্তুকি হিসেবে আলু কিনবে সরকার।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খুরশিদ আলম বলেন, দেশে আলুর ভবিষ্যৎ ভালো নয়। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় ৪০ ভাগ বেশি আলু উৎপাদন হয়। বিদেশে আলু রপ্তানি করা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের তুলনায় আলু বেশি হওয়ায় দাম কমে যাচ্ছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। এর মধ্যে হিমাগার ভাড়া বাড়ানো হলে কৃষকরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 

 

কলমকথা/ বিথী